১৯১৮-তে মজুমদারদের স্থায়ী বাস ছিলো পাকুড়িয়া গ্রামে (জেলা -পাবনা, অধুনা বাংলাদেশ) । অমিয়ভূষণের জন্ম অবশ্য দেশীয় রাজ্য কুচবিহার অথবা কোচবিহারের রাজধানী কুচবিহার শহরে; মাতামহ নিবাসে। তারিখ ৮-ই চৈত্র, ১৩২৪ (২২-শে মার্চ, ১৯১৮) । ১৯২৭ সালে কুচবিহারের জেঙ্কিন্স স্কুলে পাঠারম্ভ।তখন থেকে আমৃত্যু (কয়েকটি বছর বাদ দিলে) এই শহর-ই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। যে রাস্তার ধারে তাঁর বাড়ি, কয়েক বছর আগে পৌরসভা সেটিকে তাঁর নামে অঙ্কিত করেছে ।
জেঙ্কিন্স স্কুল থেকে দুটি লেটার নিয়ে ১৯৩৪-এ ম্যাট্রিক, এবং ১৯৩৭-এ কুচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই-এ (ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস), ১৯৩৯-এ ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি-এ । বি-এ পড়ার সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা অমিয়ভূষণের উত্তরজীবনকে প্রভাবিত করেছিল, তাঁর কথায় এই রকম-
“প্রিন্সিপ্যাল...এই পরিস্থিতিতে এক কাজ করে বসলেন, যা অসাধারণ এবং যার জন্য সেই অধ্যাপকের কাছে আমি আজন্ম কৃতজ্ঞ থেকে গেলাম। লাইব্রেরি সংলগ্ন একটা ছোট ঘর ছিলো। এই ঘরে এক আলমারি স্থাপন করে এবং তাতে বই ভর্তি করে আলমারির চাবিটা আমাকে দিলেন।পাঠ্যপুস্তক এবং আনুষঙ্গিক পাঠ এবং তারও আনুষঙ্গিক পাঠ। মাস দু-এক যেতে না যেতে এক নেশা পেয়ে বসল। (“আমার সম্বন্ধে” ১৯৭৯)
অবশ্য, এই যে পড়ার অভ্যাস যা কিনা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলের আশায় নয়, তার সূত্রপাত বহু আগেই হয়েছিলো, ‘কারণ পিতা অনন্তভূষণ লেখাপড়া বলতে বুঝতেন, অধীতব্য বিষয় ‘আগা সে গোড়া’ আত্মস্থ করা, ইম্পর্টেন্ট বেছে পড়া কদাপি নয়।’' । ফলে, পল্লবগ্রাহিতার প্রতি এক অসাধারণ ঘৃণা অমিয়ভূষণকে যে কোন প্রতিযোগিতায় ভালো ফলের লোভ থেকে দূরে রাখলো ।
কলেজের পড়া চলতে চলতেই চাকুরির চেষ্টা চালাতে হয় । ১৯৩৯-এ, হক-লীগ সরকারের আমলে বর্ণহিন্দুদের চাকুরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো । ১৯৪০-এ ডাক বিভাগে পাকা চাকুরি পাওয়া গেলো । চাকুরিতে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেড ইউনিয়ন অমিয়ভূষণকে আকর্ষণ করেছিলো । তাঁর কথায়, “ট্রেড ইউনিয়নে নিজের সবটুকু অস্মিতা ও চিন্তাশীলতাকে সংযুক্ত করে অপ্রতিষ্ঠার প্লাবনকে এক বিশেষ গণ্ডীর বাইরে রাখা ও সহস্র দুর্বল হাতে বাঁধ তুলতে অপ্রতিষ্ঠার অভিশাপকে ভুলে যাওয়া গেলো।” পরাধীন ভারতে ধর্মঘট সংগঠিত করা, পাকিস্তান-বিরোধী প্রচার চালানোর জন্য পুলিশের নজরে পড়া, কথ্য নেপালিতে পারঙ্গমতা, ইউনিয়ন অব পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ ওয়ার্কার্সের সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য হওয়া, স্বাধীন ভারতে ধর্মঘটের প্রস্তুতির জন্য গ্রেফতার এবং সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক দল ইউনিয়নের দখল নেওয়া্র পর উৎপীড়ন এবং প্রাণনাশের সম্ভাবনা – প্রায় ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে অমিয়ভূষণের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি বহুবিধ ।
১৯৪০-এর ১৪-ই ডিসেম্বর গৌরী দেবীর (১৯২৪-১৯৮৫) সঙ্গে বিবাহ । এই প্রেমময়ী নারী অমিয়ভূষণের জীবন বহুভাবে পূর্ণ করেছিলেন । ‘কেরানির চাকরি করে আর ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ করতে করতেও তিনি যে লেখক হয়ে উঠেছিলেন,তা গৌরীর অনুপ্রেরণায়।’ প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘দ্য গড অন মাউন্ট সিনাই’ - একাঙ্ক নাটক, দুই কিস্তিতে ১৩৫১ (১৯৪৪) সালে মন্দিরা পত্রিকায় । ১৯৪৬ সালে পূর্বাশায় ‘প্রমীলার বিয়ে’ ও ১৯৪৭ সালে চতুরঙ্গ পত্রিকায় ‘নন্দরানী’ – এই দুটি গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর বিশিষ্ট ভাষা ও গদ্যভঙ্গী একবর্গের পাঠক ও সমালোচকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । ১৩৬০ (১৯৫৩-৫৪) সালে প্রায় একই সঙ্গে পূর্বাশায় ‘গড় শ্রীখণ্ড’ ও চতুরঙ্গে ‘নয়নতারা’ ধারাবাহিক ভাবে ছাপা শুরু হয়েছিলো । তারপর পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ২৭টি উপন্যাস, ১১৫টি ছোটগল্প, ৫০টির বেশি প্রবন্ধ, এবং ৬-টি একাঙ্ক নাটক প্রকাশিত হয়েছে ।
একবর্গের সপ্রশংস দৃষ্টি – তা কি দু ভাবে কাজ করেছে ? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো উচ্চকোটির কবি-সমালোচকের অমিয়ভূষণের কাছে (কবিতায়) অনুরোধের কথা যদি ধরি - “আরো উষ্ণতা রাখুন, আমায় পাঠক হিসেবে বেছে নিন” । অর্থাৎ, লেখকের জনপ্রিয়তার প্রয়োজন নেই; সহৃদয়-সংবাদি লেখকের কাছে অনুমোদনের জন্য আসছেন । এবং হয়তো, যেমন অলোকরঞ্জন, তেমনি অন্য কবি-সাহিত্যিক–বিদ্বান পাঠকের কাছে প্রিয় বলেই অমিয়ভূষণের লেখার বাজারে কাটতি নেই । একটা ধন্দ আছেই; যেমন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপন্যাস পাঠ্য, আবার সবচেয়ে অধিক বিক্রীত সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর জন্য পুরো একটি অনুচ্ছেদও ব্যয় হয় না । অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার, অকাদেমি পুরস্কার, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি-লিট এবং অন্যান্য সম্মান তিনি পেয়েছেন ।
দুটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে। প্রথমত, অমিয়ভূষণের প্রায় সব লেখা সর্বপ্রথম লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। তাতে কী হয়, বহু লেখা, যাঁরা আগ্রহী হতে পারতেন, তাঁরাও পড়ার সুযোগ পাননি । লেখক খুশি ছিলেন, কারণ তিনি এক্সপেরিমেন্ট করতে পারছিলেন, এবং কোন সম্পাদক তাঁকে ফরমাশ করতে পারতেন না । দ্বিতীয়ত, এই ম্যাগাজিনগুলির অনেকগুলি স্বঘোষিত ভাবে বামপন্থী; সেক্ষেত্রে অমিয়ভুষণের অবস্থান কী? এ তো বোঝাই যায়, ‘অ্যাভলনের সরাই’ যদি ইম্রে নজের ফাঁসির প্রতিবাদ হয়, ‘সাইমিয়া ক্যাসিয়া’ চিনের তিব্বত-গ্রাসের নিন্দা । আবার, কুচবিহারের ভুমিপুত্রকন্যা, পাবনার সান্দার আর মুচি, বর্গাদার, রাভা – এদের কথা এত বিশ্বস্তভাবে, এত হৃদ্য মনোযোগে আর কেউ লেখেননি। তাঁর কথায়, “বীরেন্দ্র (চট্টোপাধ্যায়) তখনো বলতে পারত, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। কিন্তু আমি … বলতাম,ঠিক তাই, ঈশ্বর-আল্লাও তার উপরে নয়, এমনকী মার্কস-লেনিনও নয় ”
অমিয়ভুষণের আবাল্য ছবি-আঁকার শখ ছিলো। বয়স যখন আঠারো ছিলো, কুড়িগ্রামে দিদির বাড়িতে থাকার সময় ছবি এঁকে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। এই সময়ে আঁকা “কালোদি” – মাতামহীর পর্ট্রেটটি হারিয়ে যায় নি। ১৯৭৭-৭৮ সালে হঠাৎ-ই ছবিতে মন গেলো। কেন গেল, তাঁর নিজের ব্যাখ্যায় এই। “যখন লিখি না, তখন ছবি আঁকি। আমার ছবি কোনো exhibition-এ পাঠাব কিনা ভাবিনা। কিন্তু তুলির টানে ফলকে রঙ ধরলে মনে হয়, মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্ম থেকে মধুস্রাব হচ্ছে।" স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেকগুলি পর্ট্রেট এঁকেছিলেন। ১৯৯০ নাগাদ আবার ছবি আঁকা প্রায় ছেড়ে দেন। হয়তো ভবিষ্যতে যে ছবিগুলি সঞ্চিত আছে, তার মূল্যায়ন হতে পারবে।
তাঁর মৃত্যু, বা তাঁর ভাষায় ‘শেষ চিরস্থায়ী বর্তমান’ আসে কলকাতায় ৮-ই জুলাই, ২০০১ সালে ।
তাঁর রচনাসমগ্র (দে’জ পাবলিশিং) একাদশ খণ্ডে পাওয়া যায়। একটিমাত্র বিশদ জীবনী প্রকাশিত হয়েছে – এণাক্ষী মজুমদার লিখিত ‘বনেচর’।